আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-ভৌগোলিক বহুবিধ অনুষঙ্গের কারণে অঞ্চলবেধে সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রুপ পরিগ্রহ করে। তাই একটি দেশের সামগ্রিক লোকসংস্কৃতি এবং একটি বিশেষ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিতেও অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রাচীন সমতট জনপদের একাংশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই উপজেলাজেলার লোকসংস্কৃতিতে তার একটি পরিচ্ছন্ন ছাপ পরিলক্ষিত হয়। বহু ভাঙ্গা-গড়া, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের কোম্পানীগঞ্জ যা এক সময় সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। এ অঞ্চলের লোক সংস্কৃতির প্রতি একটু ঘনিষ্ট হলে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এ অঞ্চলের একটি সমৃদ্ধ লোক সংস্কৃতির পরিমন্ডল রয়েছে। লোক সংস্কৃতির একটি প্রধানতম শাখা লোকসাহিত্য। কোম্পানীগঞ্জ লোক সাহিত্য এ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেরতুলনায় অনেকটা সমৃদ্ধ এবং জীবন ঘনিষ্ঠ; তা এ অঞ্চলের প্রবাদ-প্রবচন, আঞ্চলিক গান, ধাঁ-ধাঁ, ছড়া থেকে সহজেই অনুমেয়। নিম্নেরআলোচনায় এর স্বরুপ কিছুটা উম্মোচিত হবে।
প্রবচনের কথাই ধরা যাকঃ“মাইনষের কুডুম আইলে গেলে, গরুর কুডুম লেইলে হুঁইছলে”এ প্রবচনটি গুঢ়ার্থ হলো মানুষের কুটুম্বিতা তথা আতিথেয়তা বুঝা যায় পরস্পরের আসা যাওযার মাধ্যমে আর গরুর তা বোঝা যায় লেহনের মাধ্যমে। এ প্রবচনের অর্থের সাথে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে ঐতিহ্যগতভাবেই আত্মীয় বৎসল তা বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়।“ ঝি থাইকলে জামাইর আদর, ধান থাইকালে উডানের আদর”-এ প্রবচনটির সরল অর্থ হচ্ছে কন্যার কারণেই মানুষ কন্যা জামাতাকে খাতির করে আর ধান প্রক্রিয়াজারকরণের প্রযোজনীয়তা হেতুই মানুষ উঠানের যত্নকরে।
কিন্তু এসব প্রবচনের মূলে যে সুক্ষ্ম দার্শনিক কার্যকারণবাদ রয়েছে তা কি আমরা ভেবে দেখার অবকাশ পাই।“মাছ ধোঅন হিঁড়া, গোস্ত দোঅন মিড়া”এ প্রবচনের মধ্য দিয়ে নবীন কোন রাঁধুনীকে শেখানোর চেষ্টা করা হয় যে, রান্নার আগে মাছটা খুব ভালোভাবে ধুতে হয় এবং মাংসটা অপেক্ষাকৃত কম ধুতে হবে। সাধারণ গার্হস্থ্য শিক্ষা ছাড়াও এ প্রবচন এটাই প্রমাণ করে যে, এ অঞ্চলেরমানুষ সুদীর্ঘ সময় ধরেই মাছ, মাংস খেয়ে অভ্যস্থ।“না হাইত্তে খায় হুরি, না হাইত্তে করে চুরি”এ প্রবচনের শিক্ষা হচ্ছে পারত পক্ষে মানুষ অসম্মানজনক কাজ করে না এবং সংরক্ষিত খাবার খায় না। মাছের সংকট বলেই মানুষ যেমন বাধ্য হয়েই শুটকি খায় তেমনি নিতান্ত বাধ্য হয় বলেই মানুষ চুরি করে। দার্শনিক এ শিক্ষার পাশাপাশি এ প্রবচনে চাটগাঁর মত শুটকি যে এ অঞ্চলের নৈমিত্তিক খাবার নয় তাও কিন্তুবুঝতে কষ্ট হয় না। এমনি“ হৈল হোনা গজার হোনা, যার যার হোনা তার তার হোনা”এ প্রবচনে সন্তান বাৎসল্যের সাথে সাথে আত্মমুখী ভালোবাসার মজ্জাগত বোধটি সরলভাবেই বিধৃত হয়। শোল মাছ, গজার মাছ যেগুলি কিনা রাক্ষুসে মাছ, যারা অন্য মাছের পোনা অবলীলায় খেয়ে সাবাড় করে। কিন্তু তারা নিজ নিজ পোনাকে সোনা যেমন মূল্যবান ধাতু হিসেবে মানুষ আগলে রাখে তেমনি আগলে রাখে। উপরিউক্ত প্রবচন পাঁচটির মত হাজারো প্রবচন এখানকার লোকমুখে প্রতিনিয়তই ফিরছে। শুধু আমরা তা মনোযোগী হয়ে আমলে নিইনি, নেইনা। আঞ্চলিক গানের ক্ষেত্রে যদি একটি দৃষ্টি দেই- আঞ্চলিক গানের কথা বলছি এ কারণে যে, লোকগীতি বললে তা আমাদের জেলা ছাড়িয়ে পুরো ভাটি অঞ্চলকে যুক্তকরে ফেলে। তবে ভাটিয়ালী গানে যে এ জেলার মৌলিকত্ব নেই তা নয়। ভাটিয়ালী গান-গীতির ভৌগোলিক সীমা অনেক বেশি প্রসারিত। কাজেই একটি ছোট অঞ্চলের গানই বোধ হয় প্রাধান্য পাওয়া প্রয়োজন। যেমন-“ ইদ্দুরিতান মাইজদী শঅর এত্ত লাগে বালা, যদিও নাই এ শঅরে হাঁচ তালা দশ তালা”জাতীয় গান যখন গীত হয় তখন কোট প্যান্টালুন পরা সাহেব পথচারী শিল্পীর দিকে না তাকালেও কানটাকে যে অনেকক্ষণ সেদিকে দিয়ে রাখেন তা দৃঢ়চিত্তে বলা যায়।“আঙ্গো বাড়ি নোয়াখালী রয়েল ডিস্টিক ভাই”এ গান আঞ্চলিকসাহিত্য সম্ভারে নোয়াখালী যে সঙ্গিতোপযোগী তারই স্বাক্ষর রাখে শ্রোতার শ্রুতিতে স্মৃতিতে। এ অঞ্চলেরআঞ্চলিক গান ও শ্লোক যা নোয়াখালীর গ্রামে-গঞ্জে এখনো দারিদ্র পীড়িত অধিকার বঞ্চিত মানুষকে ক্ষণিকের আয়েসী-আড্ডায় বুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তামগ্ন করে কিংবা কিঞ্চিত বিনোদিত করে এগুলোও তারই প্রমাণ।
“আঁডে গুড় গুড়, ছাঁড়ে মাডি ছ চোক তিন হুগুডি”-এ ধাঁ-ধাঁ টির উত্তর হলো হাল বা লাঙ্গল চালানো। জীবনের প্রত্যাহিকতাকে রসসিত্তু উপস্হাপন কারার ক্ষেত্রে আমাদের নিরক্ষর পুর্বসুরীরা যে মোটেই অদক্ষ ছিলেন না, এ ধাঁ-ধাঁ তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ।“আষ্ট ঠেং হোল আঁডু, তার নাম রাম টাডু, মাছ ধইত্তে যায়রে টাড়ু, হুউনাত হাতি জাল, মাছ খায় চিরকাল”মাকড়শাকে নিয়ে রচিত এ ধাঁ-ধাঁ আট পা বিশিষ্ট এ জীবের জীবন সমীক্ষণে যে গভীর পর্যবেক্ষণের পরিচয় ফুটে উঠে তাতে আমাদের পুর্বসুরীদের মেধার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবনতই হতে হয়। এরকম“ উডান ঠন ঠন হিঁড়াত বাড়ী, ধলা হিরিসতার হোন্দে দাঁড়ি”।“ কেরে ভাই চৈতি রাঙ্গা, গাছের আগাতহৈল হো'না”।“ বনের তোন্ বার অইল ভুতি, ভাত বেড়াই দিল মুতি”যথাক্রমে- রসুন, খেজুর, লেবু।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS